নিজস্ব প্রতিবেদক :: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ৯:০৫:০৬ প্রিন্ট সংস্করণ
গাজীপুরের টঙ্গীতে সিরাজউদ্দিন সরকার বিদ্যানিকেতন এন্ড কলেজের সদ্য পদত্যাগকারী অধ্যক্ষ ওয়াদুদুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিপুল পরিমান অর্থ আত্মসাৎ, পছন্দের ব্যক্তি দ্বারা গঠিত এডহক কমিটি দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা,নিজে এমপিওভূক্ত হওয়ার জন্য ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদ দাখিল,পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই কলেজ ও স্কুল শাখায় নিজস্ব পছন্দের প্রার্থীকে প্রভাষক ও শিক্ষক পদে বিধি বহির্ভূতভাবে নিয়োগ প্রদান, ব্যবহারিক ফি আত্মসাৎ, সরকারি অডিট নিষ্পত্তির জন্য অডিট কর্মকর্তাকে ঘুষ প্রদানের জন্য শিক্ষকদের সরকারি বেতন কেটে নেওয়াসহ ১৭টি বিষয়ে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরে প্রতিষ্ঠানের ৭৫জন শিক্ষক-কর্মকর্তা গাজীপুর জেলা প্রশাসক বরাবর গত ৪ সেপ্টেম্বর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
তিনি স্থানীয় সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট আজমত উল্লাহ খানের নেকনজরে থকে আলিশান বহুতল ভবন, দামি গাড়ি, ফ্ল্যাটসহ আওয়ামী লীগের শাসনামলে নামে বেনামে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগসূত্রে জানা যায়, ওয়াদুদুর রহমান গত ২০০৪ সালে সিরাজউদ্দিন সরকার বিদ্যানিকেতন এন্ড কলেজের স্কুল শাখার প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে ২০১৩ সালে উক্ত প্রতিষ্ঠানের কলেজ শাখার অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ১৯৯৫ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত একটি এনজিওতে কর্মরত ছিলেন। স্কুলে যোগদানের পর থেকেই তিনি নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি তার দুর্নীতি আড়াল করার জন্য ২০০৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত একটানা ১৭ বছর নিয়মিত কমিটির পরিবর্তে তার পছন্দের ব্যক্তি দ্বারা গঠিত এডহক কমিটি দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। এমনকি শিক্ষক প্রতিনিধিও তার পছন্দমতো মনোনয়ন করা হতো।
তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে ২০০৪ সালে নিয়োগ পাওয়ার পর এমপিওভূক্ত হওয়ার জন্য ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদ দাখিল করেন। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি সফিউদ্দিন সরকার একাডেমী এন্ড কলেজে সহকারি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন অথচ প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে মাউশির প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী সহকারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে কমপক্ষে তিন বছরের অভিজ্ঞতাসহ শিক্ষকতায় নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন। যা তার ছিল না। তিনি তার দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়া ও নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য ১জানুয়ারি ২০২৪ হতে ১৯ আগস্ট ২০২৪ইং পর্যন্ত তথাকথিত কিছু স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিকদের ৩ লাখ ৫২ হাজার ৪৪ টাকা তার ইচ্ছামতো প্রদানের প্রমানাদি পাওয়া গেছে। যা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির কারণ ঘটিয়েছেন।
তিনি ২০২৪ সালের এসএসসি, এইচএসসি ভোকেশনাল ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের বিশেষ ক্লাস হতে প্রায় ১৩ লাখ ৩০ হাজার ২৫০টাকা আত্মসাত করেন। এছাড়াও পঞ্চম, অষ্টম, দশম জেনারেল ও ভোকেশনাল এবং দ্বাদশ শ্রেণির বিশেষ ক্লাস থেকে অবৈধভাবে কোনো স্বাক্ষর ছাড়া লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাত করেন।
তিনি প্রতিষ্ঠানের অর্থে বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের তুষ্ট করতে যেকোনো অনুষ্ঠানই অতিরঞ্জিতভাবে উদযাপন করতেন এবং স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার নিমিত্তে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দীর্ঘসময় প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করতে বাধ্য করতেন এবং রাজনৈতিক স্লোগান দেওয়ানোর মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছেন। ওয়াদুদুর রহমান এসএসসি ভোকেশনাল (৯ম ও ১০ম শ্রেণির) শিক্ষার্থীদের ইন্ডাষ্ট্রিয়াল এটাচমেন্ট পরীক্ষার টাকা আত্মসাতের জন্য বিধিবর্হিভূতভাবে আউচপাড়াস্থ বৃটিশ আমেরিকান টেকনোলজি এন্ড ম্যানেজমেন্ট ইনষ্টিটিউট নামক নিজের প্রতিষ্ঠানে এনরোল করাতেন। সেখানে ৬ সপ্তাহ বাস্তব প্রশিক্ষণ বাবদ শিক্ষার্থী প্রতি ১হাজার টাকা করে ফি আদায় করে বেশিরভাগ টাকা তিনি নিজে আত্মসাত করেন।
সরকারি অডিট নিস্পত্তির জন্য তৎকালীন অডিট কর্মকর্তাকে (প্রলয় কুমার) ২০১৮ সালে ১৭ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়ার নাম করে প্রতিষ্ঠানের এমপিওভূক্ত শিক্ষকদের চাকরির ভয় দেখিয়ে প্রতি শিক্ষকদের দুই মাসের সরকারি বেতনের টাকা তাদের কাছ থেকে আদায় করে নেন। অদ্যাবধি সেই অডিটের রিপোর্ট বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের কাউকে কিছু জানানো হয়নি।
সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক ব্যতীত অন্য কোনো বই পাঠ্য করার নিয়ম নেই। সরকারি সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ও বিধিবর্হিভূতভাবে শিশু শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অতিরিক্ত দু’য়ের অধিক বই পাঠ্য তালিকায় অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে। যার ফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় ও অভিভাবকদের উপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ পড়েছে। অতিরিক্ত বইয়ের জন্য বিভিন্ন প্রকাশনি থেকে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণ অর্থ অধ্যক্ষ ওয়াদুদুর রহমান নিজেই আত্মসাত করেন। এছাড়াও লিখিত অভিযোগে প্রতিষ্ঠানের চব্বিশ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা উচ্চতর স্কেল, বিএড স্কেল, টাইম স্কেল পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করার পরও সাবেক অধ্যক্ষ ওয়াদুদুর রহমান নানা তালবাহানায় কালক্ষেপন করে শিক্ষকদের প্রাপ্য টাকা হতে বঞ্চিত করা, মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক ও ভোকেশনাল শাখার অভ্যন্তরিন এবং পাবলিক পরীক্ষার ব্যবহারিক ফি হিসেবে নেওয়া অর্থ থেকে বিষয় শিক্ষককে নামমাত্র সম্মানী দিয়ে এর সিংহভাগ টাকা তিনি একাই আত্মসাত, ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা কোভিড-১৯ এর কারণে অনুষ্ঠিত না হলেও পরীক্ষার নামে আদায়কৃত ফরমফিলাপের টাকা শিক্ষার্থীদের ফেরত না দিয়ে তিনি গোপনে আত্মসাতেরও অভিযোগ উঠেছে।
এষিষয়ে যোাগযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানের সহকারি প্রধান শিক্ষক মজিবুর রহমান বলেন, “ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে গত ১৯ আগস্ট কলেজ অধ্যক্ষ ওয়াদুদুর রহমান পদত্যাগ করেন। তার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগটি ডিসি মহোদয় তদন্ত করে দেখছেন।”
এব্যাপারে সিরাজ উদ্দিন সরকার বিদ্যানিকেতন এন্ড কলেজের সদ্য পদত্যাগকারী অধ্যক্ষ ওয়াদুদুর রহমানের মুঠোফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে একাধিক ফোন দিলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে ওয়াটসঅ্যাপে এক ক্ষুদে বার্তা পাঠালে এর জবাবে তিনি জানান, ‘আমি এখন ঢাকার বাইরে আছি। এক সপ্তাহ পর আমি ঢাকায় ফিরবো। তখন আপনার সঙ্গে কথা বলবো ইনশাআল্লাহ।’