সংবাদপত্র বার্তা ডেস্ক :: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ১১:২২:৪৫ প্রিন্ট সংস্করণ
রাজনৈতিক পালাবদলের সুযোগ নিয়ে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের হয়রানিমূলক মামলায় জড়ানোর ফলে স্থবির হয়ে পড়ছে দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এসবের ফলে কর্মসংস্থানও বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা। তাঁরা বলেন, পোশাক খাতের বৃহৎ গ্রুপের উদ্যোক্তাদের হত্যা মামলায় জড়ানো হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থানসহ বেশির ভাগ বৈদেশিক আয়েরও উৎস। এসব খাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন লাখো শ্রমিক।
হয়রানিমূলক মামলার কারণে তৈরি পোশাক খাতের বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো উৎপাদন চালু রাখতে পারছে না। এদের বড় বড় কার্যাদেশ অন্য দেশে স্থানান্তরিত হলে সংকটে পড়বে দেশের শীর্ষ রপ্তানি আয়ের বড় খাত তৈরি পোশাক শিল্প। এ প্রেক্ষাপটে সরকারের ঘোষণা অনুসারে আগামী ২২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ভুয়া মামলা প্রত্যাহার কার্যকর হবে বলে আশা উদ্যোক্তাদের।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘দেশে এখন হত্যা মামলার নামে অরাজকতা চলছে। এই ব্যর্থতার দায় সরকারের। যারা এমন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাদের শাস্তি দিতে হবে। এসব মামলার বাদীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
এফবিসিসিআইয়ের আরেক সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, ‘একটি সুকৌশলী কুচক্রী মহল সমাজ ও অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা এবং অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই অশুভ গোষ্ঠীকে প্রতিহত ও পূর্ণশক্তি দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন গণ-আন্দোলনের ফলস্বরূপ উদ্ভূত নতুন বাংলাদেশ এবং প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর পূর্ণ আস্থা রয়েছে।
সূত্র বলছে, ফকির গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৫০ হাজারের মতো কর্মী রয়েছেন। তাঁদের তৈরি পোশাক কারখানার ঝুটসহ বিভিন্ন পরিত্যক্ত মালামালের ব্যবসা করেও অনেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এটি আগে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা নিয়ন্ত্রণ করতেন। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর একাধিক পক্ষ এই ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্রিয় হয়। এর জেরে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ ব্যক্তিদের নাম আড়াইহাজার থানার দুটি হত্যা মামলায় জড়ানো হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশ-ডিএমপির তথ্যমতে, ৫ আগস্ট থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর থানাগুলোয় হত্যা মামলা হয়েছে ২৪৮টি। অনুসন্ধান বলছে, মামলার বেশির ভাগ এজাহার একই ধরনের। প্রথম ১০ থেকে ২০ জন আসামি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ প্রভাবশালী কিছু পুলিশ কর্মকর্তা। এসব মামলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাদী চেনেন না আসামিকে। আসামিও বাদীর নাম শোনেননি কখনো। ২৫ আগস্ট ঢাকার দোহার থানায় হয় তেমনি একটি মামলা। এজাহারে থাকা ঠিকানার সূত্র ধরে আসামির খোঁজ করে জানা যায়, রাজনৈতিক পরিচয় না থাকা অভিযুক্ত ষাটোর্ধ্ব এই ব্যক্তি দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের একজন।
গণমাধ্যমে তিনি দাবি করেন, ‘গত ১০ বছরেও দোহার যাইনি। ব্যবসা করি জীবনভর, সে হিসেবেই সরকারে যে-ই থাকে তাদের সঙ্গেই আমাদের সখ্য থাকে। কিন্তু আমরা কোনো রাজনীতি করি না, কখনো করিও নাই। আমার নামে হত্যা মামলা হয়েছে অথচ গত ১০ বছরে আমি দোহার যাইনি। কেন কিভাবে মামলা হলো কিছুই বুঝতে পারছি না। সরকারের কাছে আবেদন করব, আমাদের যেন এভাবে অপদস্থ না করা হয়।
এই শিল্পপতিসহ ১৭৪ জনের নামে মামলার বাদী শাজাহান মাঝি বেশির ভাগ আসামিকেই চেনেন না। তাহলে কেন করলেন মামলা? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, রাজনৈতিক মামলা তাই সবাইকে চেনেন না, নেতারা যাদের নাম দিয়েছে তাদের নামই মামলায় উল্লেখ করেছেন।
এদিকে ২ সেপ্টেম্বর একই ধরনের একটি মামলা হয় রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানায়। আসামি বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী; যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি অভিযুক্তদের। তবে পুলিশ বলছে, বিনা অপরাধে কেউ শাস্তি পাবে না। কে দোষী এবং কে নির্দোষ তা খুঁজে বের করার জন্যই প্রাথমিকভাবে তদন্ত করতে হবে। অযথা কাউকে হয়রানি করা হবে না বলেও জানান পুলিশ কর্মকর্তারা। তবে গণহারে এমন মামলায় প্রকৃত দোষীরা পার পেয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
আইনজ্ঞরা বলছেন, বড় বড় ব্যবসায়ীদের নামে মিথ্যা হত্যা মামলা কেবল আইনের ব্যত্যয়ই নয়, দেশের জন্য ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের পরিপন্থী। এমন অনেক ব্যবসায়ীকেও আসামি করা হচ্ছে, যাঁদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। সূত্র বলছে, চাঁদা ও তৈরি পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ না পেয়ে এবং অনৈতিক সুবিধার জন্য অনেক ব্যবসায়ীকে আসামি করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সুহান খান বলেন, ‘ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে হলে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট অভিযোগ প্রয়োজন। তবে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও তাঁদের ঢালাওভাবে মামলায় পক্ষভুক্ত করা হচ্ছে; যা কেবল আইনের ব্যত্যয়ই নয়, দেশের জন্য ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের পরিপন্থী।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, ‘রাষ্ট্রবিরোধী একটি চক্র অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে ক্ষমতায় আসতে চায়। তারাই দেশের শিল্প-কারখানায় আক্রমণ করছে। তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-এমসিসিআই সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, ‘জ্বালাও-পোড়াও-ভাঙচুর করে কারখানা বন্ধকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। বিচারের ব্যবস্থা না করলে উৎপাদন স্বাভাবিক হবে না। কলকারখানা ঠিকমতো না চললে লাখ লাখ মানুষ বেকার হবে।