সংবাদপত্র বার্তাডেস্ক ৫ মে ২০২৪ , ২:৪০:১২ প্রিন্ট সংস্করণ
আলহামদুলিল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহি লা- তারা-হুল উইয়ূ-ন, ওয়ালা- তুখ-লিতুহুজ্জুনূ-ন, ওয়ালা- ওয়াসিফুহুল ওয়াসিফূ-ন। অচ্ছলা-তু অচ্ছালা-মু আলা মাল্লা- নাব্যিা বা’দাহু। ইসলামের প্রথম রুকন ঈমান। আর ঈমানের পরেই দ্বিতীয় ভিত্তি বা রুকন সালাত। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আল্লাহ পাক আমাদের উপর ফরজ করে দিয়েছেন। ঈমান গ্রহনের পরে প্রত্যেক মুমিন নারী পুরুষের উপরে সবচে’ গুরুত্বপূর্ন এবং বড় ফরয ইবাদত হলো, সময়মত পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাত আদায় করা। আরবী শব্দ ‘সালাত’ এর অর্থ- প্রার্থনা বা দুআ করা। ইসলামী পরিভাষায় সালাত অর্থ রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর শিখিয়ে দেয়া নিয়মে নির্ধারিত পদ্ধতিতে ক্কিয়াম, ক্কুউদ, রুকু, সিজদাহসহকারে, নির্দিষ্ট দুআ, তাসবীহ এবং সূরাহ বা আয়াত তিলাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর যিকর ও দুআ করা। পবিত্র কুরআন এবং হাদীসে সালাতের চেয়ে বেশি গুরুত্ব আর কোনো ইবাদতকে দেয়া হয় নি। কুরআন মাজীদে প্রায় ৮২ স্থানে আল্লাহ জাল্লা শানুহূ সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন, যা থেকে আমরা এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর অসংখ্য হাদীসে সালাতের গুরুত্ব আলোচিত হয়েছে।
মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনুল কারীমে ইরশাদ ফরমান:
وَأْمُرْ أَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا لَا نَسْأَلُكَ رِزْقًا نَّحْنُ نَرْزُقُكَ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوَى
”আপনি আপনার পরিবারের লোকদেরকে নামাযের আদেশ দিন এবং নিজেও এর ওপর অবিচল থাকুন। আমি আপনার কাছে কোন রিযিক চাই না। আমি আপনাকে রিযিক দেই এবং আল্লাহ ভীরুতার পরিণাম শুভ।” সূরাহ: আত্বত- হা-, আয়াত: ১৩২।
অন্য আয়াতে তিনি ইরশাদ করেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اسْتَعِينُواْ بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ إِنَّ اللّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ
”হে মুমিন গন! তোমরা ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চিতই আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন।” সূরাহ: আল বাক্কারাহ, আয়াত: ১৫৩।
অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে:
وَأَقِمِ الصَّلاَةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّـيِّئَاتِ ذَلِكَ ذِكْرَى لِلذَّاكِرِينَ
”আর দিনের দুই প্রান্তেই নামায ঠিক রাখবে, এবং রাতের প্রান্তভাগে পূর্ণ কাজ অবশ্যই পাপ দূর করে দেয়, যারা স্মরণ রাখে তাদের জন্য এটি এক মহা স্মারক।” সূরাহ: আল হূদ, আয়াত: ১১৪।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন :
بُنِيَ الإِسْلامُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ- وفي رواية: شَهَادَةِ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، وفي رواية ثالثة: أَنْ يُوَحَّدَ اللَّهُ، وفي أخرى: أَنْ يُعْبَدَ اللَّهُ وَيُكْفَرَ بِمَا دُونَهُ- وَإِقَامِ الصَّلاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ وَالْحَجِّ وَصَوْمِ رَمَضَانَ، وفي رواية: صيام رمضان والحج (متفق عليه)
“ইসলামকে পাঁচটি বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, তা হলো: বিশ্বাসের সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা (দাস) ও রাসুল বা প্রেরিত বার্তাবাহক (অন্য বর্ণনায়: একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে হবে, আল্লাহ ছাড়া যা কিছু (উপাস্য) আছে সবকিছুকে অবিশ্বাস করতে হবে), সালাত (নামায) কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, রমযান মাসের সিয়াম (রোজা) পালন করা, বাইতুল্লাহর হজ্জ আদায় করা।” (বুখারী ও মুসলিম)
ইসলাম এমনই একটি জীবন বিধান যার প্রত্যেকটি বিধানকে মানব জাতির জন্য সহজ করে দেয়া হয়েছে। অসুস্থ থাকার কারনে সুযোগ রয়েছে যে কেউ রোজা কাযা করতে পারেন এবং পরবর্তী সময়ে তা রাখতে পারেন। পুরোপুরি অক্ষম ব্যক্তি ফিদইয়া বা কাফফারা দিয়ে রোজার প্রতিবিধান করতে পারেন। এরকম অন্যান্য ইবাদাত, যেমন কেউ হজ্বে গমনে ইচ্ছুক, কিন্তু তার শারিরীক সামর্থ্য নেই, তিনি কাউকে দিয়ে বদলী হজ্ব করিয়ে নিতে পারেন। এভাবে প্রায় প্রত্যেক আমলে বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যাতে ইবাদাতের সাওয়াব থেকে সুস্থ, অসুস্থ, মাজুর, মুসাফির, মুকিম কেউই বঞ্চিত না হন। কিন্তু একমাত্র সালাতের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। যার সালাত তাকেই পড়তে হবে। এবং সময়মত পড়তে হবে। তবে, সালাতকে অন্যভাবে সহজ করা হয়েছে। তা হচ্ছে, মুমিন ব্যক্তি যেভাবে পারেন সেভাবেই তিনি সালাত আদায় করবেন। প্রথমত: সাধারন নিয়মে প্রত্যেক সুস্থ ব্যক্তি পরিপূর্নভাবে যথানিয়মে সালাত আদায় করবেন। অপারগতায় যিনি যেভাবে পারেন আদায় করবেন। কেউ দাঁড়াতে অক্ষম হলে বসে বসে পড়বেন। বসতে অক্ষম হলে শুয়ে শুয়ে পড়বেন। যানবাহনের আরোহী অবস্থায় থাকলে সেখানে সালাত আদায় করে নিবেন। এমনকি কারও নিকট যদি কোনো পোষাক না থাকে, এমনকি উলঙ্গ অবস্থায় সালাতের সময় হয়ে যায়, সেই অবস্থায় তিনি সালাতে দাঁড়িয়ে যাবেন। অর্থাত, প্রভূর ডাকে তাঁর দরবারে পাঁচ বেলার হাযিরা আপনাকে দিতেই হবে। পবিত্র কুরআনের একটি সূরাহও যিনি জানেন না, তিনিও সালাত আদায় করবেন। তাকেও প্রতিপালকের দরবারে হাযিরা দিতে হবে। তিনি আল্লাহু আকবার বলে হাত বেঁধে সালাতের ভেতরে তাসবীহ তাহলীল, সুবহানাল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ এগুলোর যিকির করে সালাত আদায় করবেন। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই সালাতে সময়মত হাযিরা না দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। সংক্ষিপ্ত কথা হচ্ছে, একজন মুমিন ব্যক্তির দেহে প্রান যতক্ষন আছে, যতক্ষন হুশ জ্ঞান আছে, তার অবধারিত এবং অবশ্য পালনীয় ফরজ বিধান সালাত তিনি কোনো অবস্থাতেই ত্যাগ করতে পারেন না। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করা হয়েছে:
حافظوا على الصلوات والصلاة الوسطى وقوموا لله قانتين. فإن خفتم فرجالا أو ركبانا فإذا أمنتم فاذكروا الله كما علمكم ما لم تكونوا تعلمون.
“তোমরা সালাতের প্রতি যত্নবান হও, বিশেষত মধ্যবর্তী সালাতের, এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তোমরা বিনীতভাবে দাঁড়াবে। যদি তোমরা আশংকিত থাক তবে পদচারী অথবা আরোহী অবস্থায়, আর যখন নিরাপদ বোধ করবে তখন যেভাবে তিনি তোমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, যা তোমরা জানতে না।” সূরাহ: বাকারা, আয়াত:২৩৮-২৩৯।
পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আল্লাহ পাক প্রদত্ত ফরজ বিধান। এই সালাতকে আমরা আমাদের পক্ষ থেকে অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব মনে করি। কিন্তু আসলে ভেবে দেখলে বুঝা যায়, সালাত কোনো দায়িত্ব নয়, মহাসৌভাগ্য লাভের সুবর্ন সুযোগ। মহান প্রভূ পালয়িতা আমাদের জন্য অনন্য সুযোগ রেখে আমাদের ধন্য করেছেন, প্রতি দিন পাঁচ পাঁচবার মহান রব সৃষ্টিকর্তার সাথে কথা বলে, মনের সকল আবেগ তাঁকে জানিয়ে, তাঁর রহমত, বরকত লাভ করে যাতে আমরা ধন্য হতে পারি। কুরআন সালাতকে সকল সফলতার চাবিকাঠি হিসেবে উল্লেখ করেছে। মহান আল্লাহ বলেন:
قد أفلح المؤمنون. الذين هم في صلاتهم خاشعون
“মুমিনগণ সফলকাম হয়েছেন, যারা অত্যন্ত বিনয় ও মনোযোগিতার সাথে সালাত আদায় করেন।” সূরাহ: আল মু’মিনূন, আয়াত: ১ এবং ২।
قد أفلح من تزكى وذكر اسم ربه فصلى
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে: “সেই ব্যক্তিই সাফল্য অর্জন করতে পারে, যে নিজেকে পবিত্র করে এবং নিজ প্রভুর নাম স্মরণ করে সালাত আদায় করে।” সূরাহ: আ’লা-, আয়াত: ১৪ এবং ১।
সালাত মনের প্রশান্তি। চক্ষুর শীতলতা। শরীরের শক্তি। অন্তরের সাহস। সালাত মানুষকে পরিপূর্ন মানুষ হওয়ার পথ দেখায়। তাকে পরিশীলিত এবং পরিমার্জিত করে মানবতার পূর্নতার শিখরে উঠিয়ে দেয়। এর মাধ্যমে মুমিন আল্লাহ পাকের স্মরন খুঁজে নেন। সকাতর প্রার্থনায় অর্জন করেন মানসিক দৃঢ়তা এবং ভারসাম্য। অন্তরের ব্যথা বেদনা, না বলা কষ্ট দু:খ, অপ্রাপ্তির হাহাকার ব্যক্ত করে কাটিয়ে ওঠেন সকল মানবিক দুর্বলতা। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে:
إن الإنسان خلق هلوعا إذا مسه الشر جزوعا وإذا مسه الخير منوعا إلا المصلين الذين هم على صلاتهم دائمون
“নিশ্চয় মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই অস্থিরচিত্ত ও ধৈর্যহারা। বিপদে পড়লে সে অধৈর্য ও হতাশ হয়ে পড়ে। আর কল্যাণ বা সম্পদ লাভ করলে সে কৃপণ হয়ে পড়ে। একমাত্র ব্যতিক্রম সালাত আদায়কারীগণ (তারা এই মানবীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন।) যারা সর্বদা (নিয়মিতভাবে) সালাত আদায় করেন।” (মাআরিজ ১৯-২২)
সালাত গোনাহ মার্জনার অন্যতম উপায়।
আবূ উমামা রাদিআল্লাহু তাআ’-লা আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
من توضأ فأسبغ الوضوء … ثم قام إلى الصلاة المفروضة غفر الله له في ذلك اليوم ما مشت إليه رجله وقبضت عليه يداه وسمعت إليه أذناه ونظرت إليه عيناه وحدث به نفسه من سوء. (أحمد والطبراني بسند قوي)
‘যে ব্যক্তি ওযু করবে এবং পূর্ণরূপে তা সম্পন্ন করবে … অতঃপর সে ফরয সালাতে দাঁড়াবে, আল্লাহর তার সেই দিনে তার দুই পা যা চলেছে, তার দুই হাত যা ধরেছে, তার দুই কান যা শুনেছে, তার দুই চোখ যা দেখেছে এবং তার মনে যা কিছু খারাপ কল্পনা করেছে ক্ষমা করে দেবেন।’ (আহমদ, তাবারানী)
অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা রাদিআল্লাহু তাআ’-লা আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
أرأيتم لو أن نهرا بباب أحدكم يغتسل منه كل يوم خمس مرات هل يبقى من درنه شيء قالوا لا يبقى من درنه شيء قال فذلك مثل الصلوات الخمس يمحو الله بهن الخطايا (متفق عليه)
“যদি তোমাদের কারো বাড়ির দরজায় একটি নদী থাকে, যেখানে সে প্রতিদিন পাঁচবার গোসল করে, তবে তার দেহে কি ধুলি ময়লা কিছু অবশিষ্ট থাকবে? সাহাবীগণ বলেন: না। তার ধুলিময়লা কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। তিনি বলেন: পাঁচ ওয়াক্ত সালাতও অনুরূপ। এগুলির মাধ্যমে আল্লাহ পাপরাশি ক্ষমা করেন।” (বুখারী ও মুসলিম)
নামায মুমিন ও কাফিরের মধ্যে মাপকাঠি
হাদিস অধ্যয়নে আমরা জানতে পারি, নামায মুমিন এবং কাফিরের মধ্যে মাপকাঠি। নামায ত্যাগ করলে মানুষ কাফিরদের দলভুক্ত হয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
بين الرجل وبين الشرك والكفر ترك الصلاة (مسلم)
“একজন মানুষ ও কুফরী-শিরকের মধ্যে রয়েছে নামায ত্যাগ করা।” (মুসলিম)
তিনি আরো বলেন:
من ترك الصلاة فقد كفر (صحيح ابن حبان)
“যে ব্যক্তি নামায ছেড়ে দিল সে কাফির হয়ে গেল।” (ইবনু হিব্বান)
ইসলামী শরীয়াহ তথা, কুরআন ও হাদীসের শিক্ষার আলোকে একথা নিশ্চিত যে, সালাত মুসলিমের মূল পরিচয়। সালাত ছাড়া মুসলিমের অস্তিত্ব কল্পনাতীত। স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে জেনে বুঝে সালাত পরিত্যাগকারী কখনোই মুসলিম বলে গণ্য হতে পারেন না। বরং, যদি কোনও ব্যক্তি মনে করেন, বা ধারনা পোষন করেন যে, নামায না পড়লেও ভাল মুসলমান থাকা যায়, অর্থাত, নামাজ ছেড়ে দিলেও তার মুসলমানিত্বের কোনো ক্ষতি হয় না এবং মুসলমানিত্ব টিকে থাকে, হাদিসের বক্তব্য অনুসারে, সেই ব্যক্তি সন্দেহাতীতভাবে কাফির ও অমুসলিম। তা তিনি যতবারই মুখে মুখে নিজেকে মুসলিম দাবি করতে থাকুন না কেন। এবং যতবড় সম্ভ্রান্ত বংশ পরিচয়ের অধিকারীই হোন না কেন। কারন, এই হাদিস যিনি বলেছেন, তিনি আর কেউ নন, এই শরীয়াতের আনয়নকারী স্বয়ং আল্লাহর রাসূল, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
আর যিনি সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করেন যে, নামায কাযা করলে কঠিনতম গোনাহ হয়। এবং তিনি একথাও জানেন, দিনরাত শূকরের গোশত ভক্ষণ করা, মদ্যপান করা, রক্তপান করা ইত্যাদি ভয়ঙ্কর সব গোনাহের চেয়েও বেশী গোনাহ হলো ইচ্ছাপূর্বক এক ওয়াক্ত নামায কাযা করা। এমন ব্যক্তি যদি ইচ্ছা করে কোন নামায ত্যাগ করেন তাহলে তাকে মুসলমান বলে গণ্য করা হবে কি না সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। সাহাবী-তাবেয়ীগণের যুগে এই প্রকারের ব্যক্তিদেরকেও কাফির বা অমুসলিম বলে গণ্য করা হত। সহীহ হাদীসে তাবিয়ী আব্দুল্লাহ ইবনু শাকীক বলেন:
كان أصحاب محمد صلى الله عليه وسلم لا يرون شيئا من الأعمال تركه كفر غير الصلاة (الترمذي)
“মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -সাহাবীগণ সালাত ছাড়া অন্য কোনো (ফরয) কর্ম ত্যাগ করাকে কুফরি মনে করতেন না।” (তিরমিযী)
চার ইমামের মধ্যে ইমাম আহমদ ও আরো অনেক ফকীহ এই মত পোষণ করেন। এদের মতে মুসলিম কোন পাপকে পাপ জেনে পাপে লিপ্ত হলে কাফির বলে গণ্য হবে না। একমাত্র ব্যতিক্রম নামায ত্যাগ করা। যদি কেউ নামায ত্যাগ করাকে কঠিনতম পাপ জেনেও এক ওয়াক্ত ফরয নামায ইচ্ছা পূর্বক ত্যাগ করেন তাহলে তিনি কাফির ও মুরতাদ বলে গণ্য হবেন। ইমাম আবু হানীফা, ইমাম শাফিয়ী প্রমুখ ইমাম বলেন যে, এই দ্বিতীয় ব্যক্তিকে সরাসরি কাফির বলা যাবে না, তবে তাকে নামায ত্যাগ্যের শাস্তি স্বরূপ জেল ও মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে হবে।”
এক ওয়াক্ত ফরয সালাত ইচ্ছাকৃতভাবে কাযা করলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’-লা- এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর যিম্মাদারী থেকে তার নাম কাটা যাবে বলে সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
لا تترك صلاة مكتوبة متعمدا فمن تركها متعمدا فقد برئت منه الذمة (ذمة الله وذمة رسوله)
“ইচ্ছাপূর্বক এক ওয়াক্ত ফরয সালাতও পরিত্যাগ করবে না। কারণ যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক এক ওয়াক্ত ফরয সালাত পরিত্যাগ করবে, সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’-লা-র যিম্মা ও তাঁর রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যিম্মা থেকে বহিস্কৃত হবে।” (ইবনু মাজাহ, বাইহাকী, তাবারানী, আহমদ, সহীহুত তারগীব)
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
أول ما يحاسب العبد يوم القيامة الصلاة فإن صلحت صلح سائر عمله وإن فسدت فسد سائر عمله
“কেয়ামতের দিন বান্দাকে সর্বপ্রথম তার সালাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। যদি সালাত সঠিক হয়, তবে তার অন্য সকল আমল টিকে যাবে। আর সালাতই যদি নষ্ট হয় তবে তার অন্য সকল আমল নষ্ট হয়ে যাবে।” (তিরমিযী, মুখতারাহ)
নফল সালাত, নফল ইবাদত সৌভাগ্যের চাবিকাঠি!
ফরয সালাত যেমন মুমিন জীবনের শ্রেষ্ঠতম ইবাদত, তেমনি নফল সালাতও সর্বশ্রেষ্ঠ নফল ইবাদত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের অন্যতম উপায়। ফরযের অতিরিক্ত কর্মকে “নফল” বলা হয়। কিছু সময়ে কিছু পরিমাণ “নফল” সালাত পালন করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উৎসাহ দিয়েছেন, বা তিনি নিজে তা পালন করেছেন। এগুলিকে “সুন্নাত” ও বলা হয়। যে সকল নফল সালাতের বিষয়ে তিনি বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন সেগুলিকে “সন্নাতে মুয়াক্কাদাহ” ও অন্যগুলিকে সুন্নাতে গাইর মুয়াক্কাদাহ বলা হয়। এ ধরণের কিছু সুন্নাত সালাত সম্পর্কে হাদীসে বেশি গুরুত্ব প্রদানের ফলে কোনো কোনো ইমাম ও ফকীহ তাকে ‘ক্করিবুমমিনাল ওয়াজিব’ (ওয়াজিবের কাছাকাছি) কিংবা ‘ওয়াজিব’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আল্লাহ পাকের অধিকতর নৈকট্য লাভ, পুরস্কার, মর্যাদা ও সম্মান অর্জনের মাধ্যমই হলো নফল ইবাদত। নফল ইবাদতসমূহের মধ্যে নফল সালাতের গুরুত্ব অপরিসীম। অনেককেই ‘নফল’ নামাযে অবহেলা করতে দেখা যায়। এটা মোটেই উচিত নয়। প্রতিটি নফল আমলের যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণের অনুকরনীয় এবং আদর্শ জীবনের দৃষ্টিপাত করলে আমরা কী দেখতে পাই? তাঁদের সারা জীবনের আমল অনুসন্ধান করেও নফল আদায়ের প্রতি অনিহা বা অলসতা খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং, সকল প্রকার নফল ইবাদতের প্রতি সীমাহীন গুরুত্ব ও আগ্রহ ছিল আমৃত্যু। নফল সালাত, নফল সিয়াম, নফল তিলাওয়াত, নফল যিকর, নফল দান ইত্যাদির জন্য তাঁরা ছিলেন সদা উদগ্রীব ও ব্যস্ত। প্রতিদিন নিয়মিত তাঁরা এ সকল ইবাদত আদায় করতেন। বিশেষত নফল সালাতের ক্ষেত্রে তাঁদের আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি।
মহাগ্রন্থ আলকুরআনে নফল সালাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বারংবার মুমিনদেরকে রাত্রিতে কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অগণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মাতকে বেশি বেশি নফল-সুন্নাত সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। বিভিন্ন সহীহ হাদীসে সাধারণভাবে যত বেশি পারা যায় নফল সালাত আদায়ের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এক সাহাবী প্রশ্ন করেন, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় কাজ কী? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
عليك بكثرة السجود لله فإنك لا تسجد لله سجدة إلا رفعك الله بها درجة وحط عنك بها خطيئة (مسلم)
“তুমি আল্লাহর জন্য বেশি বেশি সাজদা করবে (বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করবে); কারণ তুমি যখনই আল্লাহর জন্য একটি সাজদা কর, তখনই তার বিনিময়ে আল্লাহ তোমার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং তোমার একটি পাপ মোচন করেন।” (মুসলিম)
অন্য এক সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর নিকট আবেদন করেন যে, তিনি জান্নাতে তাঁর সাহচর্য চান। তিনি বলেন:
فأعنى على نفسك بكثرة السجود (مسلم)
“তাহলে বেশি বেশি সাজদা করে (নফল সালাত আদায় করে) তুমি আমাকে তোমার বিষয়ে সাহায্য কর।” (মুসলিম)
অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু তাআ’-লা আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
الصلاة خير موضوع فمن استطاع أن يستكثر فليستكثر (الطبراني، صحيح الترغيب)
“সালাত সর্বশ্রেষ্ঠ বিষয়, কাজেই যার পক্ষে সম্ভব হবে সে যেন যত বেশি পারে সালাত আদায় করে।” হাদীসটি হাসান। (তাবারানী, সহীহুত তারগীব)
আমরা কত সময় নষ্ট করি অকারণে। সামান্য অপ্রয়োজনীয় পার্থিব লাভ বা স্বার্থের জন্য কত সময় ব্যয় করি। অথচ এগুলির চেয়ে দুই রাক‘আত নফল নামাযের মূল্য অনেক বেশি। আবূ হুরাইরা রাদিআল্লাহু তাআ’-লা আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এই কবরটি কার? তাঁকে বলা হলো, এটি অমুকের কবর। তখন তিনি বলেন:
وعن أبي هريرة أن رسول الله صلى الله عليه وسلم مر بقبر فقال من صاحب هذا القبر فقالوا فلان فقال ركعتان أحب إلى هذا من بقية دنياكم (الطبراني في الأوسط ورجاله ثقات، وحسنه الألباني)
“দুই রাক‘আত সালাত এই লোকটির কাছে তোমাদের দুনিয়ার বাকি সকল কিছুর থেকে বেশি প্রিয়।” (তাবারানী)
সাধারণভাবে নফল সালাত ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বা স্থানে বিশেষ সালাতের বিশেষ মর্যাদা বা ফযীলতের কথাও সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে অন্যতম হলো রাতে তাহাজ্জুদ বা কিয়ামুল্লাইল এবং সূর্যোদয়ের পরে দ্বিপ্রহরের আগে যোহা বা চাশতের নামায। কিয়ামুল্লাইলের বিষয়ে কুরআন কারীমে বারংবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদকে মুমিনের মূল পরিচয় হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবীগণও কখনোই তাহাজ্জুদ ছাড়তে বা অবহেলা করতে রাজি ছিলেন না। আয়েশারাদিআল্লাহু তাআ’-লা আনহা বলেন
لا تدع قيام الليل فإن رسول الله كان لا يدعه وكان إذا مرض أو كسل صلى قاعدا (أبو داود، صحيح الترغيب)
“কখনো তাহাজ্জুদের নামায ত্যাগ করবে না ; কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো তাহাজ্জুদ ত্যাগ করতেন না। যদি কখনো অসুস্থ থাকতেন অথবা কিছুটা ক্লান্তি বা অবসাদ অনুভব করতেন তাহলে তিনি বসে তাহাজ্জুদ আদায় করতেন।” (আবূ দাউদ, সহীহুত তারগীব)
অনেক হাদীসে আমরা দেখতে পাই যে, কোনো সাহাবী তাহাজ্জুদ পালনে সামান্য অবহেলা করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপত্তি করেছেন।
চাশতের বা যোহার সালাতের বিষয়ে অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
من صلى الصبح في جماعة ثم قعد يذكر الله حتى تطلع الشمس ثم صلى ركعتين كانت له كأجر حجة وعمرة … تامة تامة تامة (الترمذي، وصحيح الترغيب وحسنه)
“যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামা’আতে আদায় করে বসে বসে আল্লাহর যিকির করবে সূর্যোদয় পর্যন্ত, এরপর দুই রাক’আত নামায আদায় করবে, সে একটি হজ্ব ও একটি ওমরার সাওয়াব অর্জন করবে : পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ (হজ্ব ও ওমরার সাওয়াব অর্জন করবে।)” (তিরমিযী, সহীহুত তারগীব)
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
من صلى صلاة الصبح في جماعة ثم ثبت حتى يسبح لله سبحة الضحى كان له كأجر حاج ومعتمر تاما له حجه وعمرته (صحيح الترغيب، وحسنه الألباني والمنذري)
“যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামাতে আদায় করে বসে থাকবে দোহার (চাশ্তের) নামায আদায় করা পর্যন্ত, সে একটি পূর্ণ হজ্ব ও একটি পূর্ণ ওমরার মতো সাওয়াব পাবে।” (সহীহুত তারগীব)
এছাড়া মাগরিবের পরে ছয় রাকাআ’ত আউয়াবীনের সালাত, ওযুর পরপর দুই রাকআত তাহিয়্যাতুল ওযূ, মসজিদে প্রবেশ করে বসার পূর্বে অন্তত: দুই রাকা‘আত দুখূলুল মাসজিদ বা তাহিয়্যাতুল মাসজিদ সালাত নিয়মিত আদায় করার বিশেষ ফযীলত বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
নফল সালাত ফরজ সালাতের ঘাটতি পূরন করবে!
হাদিসের ভাষ্যানুসারে, নফল সালাত ফরজ সালাতের ঘাটতি পূরন করবে। ক্কিয়ামতের দিন কোনো বান্দার ফরজ সালাতের হিসাবের সময় তার সালাতের ঘাটতি দেখা দিলে আল্লাহ পাকের নির্দেশে তার কোনো নফল সালাত আছে কি না, তা খোঁজ করে দেখা হবে। নফল সালাত পাওয়া গেলে সেগুলো নেকির পাল্লায় তুলে দেয়া হবে। এবং তার মাধ্যমে যদি তার ঘাটতি পূরন হয়ে যায়, তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। তার হিসাব মিলে যাবে। সুবহানাল্লাহ। আল্লাহ পাক কত মহান! তাহলে বুঝুন, নফল সালাতের গুরুত্ব কত হবে!
হাদিসে সালাতকে বলা হয়েছে জান্নাতের ‘চাবিকাঠি’। আজকের সমাজের করুন অবস্থা আমাদের সামনে রয়েছে। ইসলামের সবচে’ গুরুত্বপূর্ন ইবাদত সালাত আদায়ে অনিহা আমরা প্রত্যক্ষ করি। আমাদের ঘরে-বাইরে আমরা সালাতের ব্যাপারে উদাসীনতা লক্ষ্য করি। গাফলতের এই নিদ্রা ভেঙ্গে এ জাতিকে ইবাদতের মাধ্যমে আবারও তাদের স্বর্নোজ্জ্বল অতীত ফিরিয়ে আনতে হবে। দাওয়াতের ব্যাপক কাজ আঞ্জামের মাধ্যমে বিপথগামী, পথহারা এই জাতির সূর্যসন্তানদের দ্বীনের আলোয় টেনে আনতে হবে। কবির ভাষায় বলতে হয়-
‘ঘুমিয়ে কাযা করেছি ফজর,
তখনো জাগিনি যখন যোহর,
হেলা ও খেলায় কেটেছে আসর,
মাগরিবের আজ শুনি আজান,
ওরে বেখবর, জলদি ছুটে আয়, ইশার জামাআ’তে এখনও আছে স্থান।’
মহান আল্লাহ পাক আমাদেরকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলার তাওফিক প্রদান করুন। তাঁর হুকুমগুলো প্রিয় রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দেখানো পথে সঠিকভাবে পালন করার সৌভাগ্য দান করে ধন্য করুন।
-নব নকিব, সামু ব্লগ থেকে সংকলিত